রানা প্লাজা ধ্বসের ৯ বছর: বিচারে ধীরগতি
ঢাকা: সাভারের রানা প্লাজা ধস গোটা বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।আজ সেই রানা প্লাজা ধ্বসের ৯ বছর।
দেশের ইতিহাসে কঠিন এ ট্র্যাজেডি ঘটে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল।
এ ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন। রানা প্লাজা ধসের পর ৯ বছর পেরিয়ে গেছে, তবে এ ঘটনায় বিভিন্নভাবে দায়ীদের বিচারে অগ্রগতি খুব সামান্য।
এ ঘটনায় হওয়া হত্যাকাণ্ডের মূল মামলায় বিচার শুরুর ছয় বছর পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভবনের মালিক রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পাঁচটি মামলা হয়।
এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা দায়ের করে।
সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলায় রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়েছে ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট।এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এছাড়া ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা রয়েছে। দুদকের মামলায় বিচার হলেও ভবন ধসের ঘটনায় মূল মামলায় বিচারের অগ্রগতি খুব সামান্য। এ ঘটনায় হওয়া দুটি মামলাতেই পাঁচ বছর আগে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। এর মধ্যে সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন উচ্চ আদালতে যান। তাদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। সম্প্রতি মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্যদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে ফের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওইদিন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে মামলার বাদী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের উপ-পরিদর্শক ওয়ালী আশরাফ জবানবন্দি দেন। গত ১৬ এপ্রিল আসামিপক্ষ তাকে জেরা করেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৯ মে দিন ধার্য রয়েছে।
রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার বলেন, হাইকোর্ট এ মামলার অভিযুক্ত ৮ আসামির কার্যক্রম স্থগিত করেছিল। আসামিরাই বিভিন্ন কারণে উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাকে বিলম্বিত করেছে। সেসব জটিলতা কাটিয়ে মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
হত্যা মামলায় সিআইডির অভিযোগপত্রে ঘটনার বিবরণীতে এসেছে, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমইএর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে আসেন। গার্মেন্টস মালিকদের পরামর্শ দেন, বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে।
কিন্তু পাঁচ গার্মেন্টস মালিক এবং তাদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন ২৪ এপ্রিল শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর সঙ্গে যোগ দিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না। ’
বাণিজ্যিক এ ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। এসব কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দেয়। কিন্তু মালিকপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে পরদিন পাঁচটি পোশাক কারখানা চালু করে। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে। ঠিক তখনই রানা প্লাজা ভবন বিকট শব্দ করে ধসে পড়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।