মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩; সময়: ৭:২৫ অপরাহ্ণ |

বিপ্লব দে

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। শুধু সীমান্তে, শরণার্থী শিবিরে বা রণাঙ্গনেই নয়, কূটনৈতিক অঙ্গন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণের ভূমিকা ও অবদান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

১৯৭১ সাল বাংলাদেশে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন পড়শি দেশ হিসেবে ভারত ও দেশটির সাধারণ মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতের গণমানুষের সহযোগিতার সেই ইতিহাস তাৎপর্যপূর্ণ ও গৌরবের বটে। প্রায় এক কোটি মানুষ দেশান্তরিত হয়ে আশ্রয় নেয় ভারতে। শুধু তাই নয় ভারত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে আরেক ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতার রক্তাক্ত যুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের মাটি ও মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ভারত সরকার একদিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন শরণার্থীদের, অন্যদিকে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানগুলো পরিণত হয়েছিল মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। এভাবেই একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখতে শুরু করে।

ভারতের সর্বস্তরের মানুষ তথা রাজনীতিবিদ, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী, গৃহিনী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ শ্রমজীবী যারা ইতিহাসের যুগ-সন্ধিক্ষণে নিজেদের আবেগ ও যুক্তিতে বরণ করে নিয়েছিলেন এক কোটি শরনার্থী, একাত্ম হয়েছিলেন পরম বন্ধু হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাতারে। নিজেদের দেশ থেকে বিতারিত হয়ে আসা বিবর্ণ মুখগুলোর জন্য ভারতের সাধারণ মানুষের ভালবাসা ছিল সীমাহীন। মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলাদেশের মাটি, রচিত হয়েছে আরেক অমচোনীয় ইতিহাস। এসব ঘটনাবর্তে মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের সকল স্তরের মানুষের অবদান বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনও ওষুধ, কখনও খাদ্য কিংবা কখনও সেবার মাধ্যমে বুকভরা ভালবাসা দিয়ে ভারতের মানুষ যে ঋণের জালে আবদ্ধ করেছে, তা কোন দিন ভুলতে পারবে না বাংলাদেশের মানুষ।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত পৃথিবীর মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সীমান্ত। বর্বর পাকিস্তানী সেনা অভিযানে দেশত্যাগীদের সিংহভাগ ঢুকে পড়ে ভারতে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যে সর্বমোট ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন শরণার্থী প্রবেশ করেন। বিপুল এই ছিন্নমূল মানুষের দায়িত্ব নিতে হয় ভারত সরকারকে। ভারতের সাধারণ মানুষ ও সরকারের জন্য এটা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

দীর্ঘ ২৩ বছরের সামরিক এবং ধর্মতান্ত্রিক নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালী জনতার সংগ্রাম ঘটে একাত্তর সালে। অনিবার্যভাবে শুরু হয় ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ধ্বংসযজ্ঞ ও লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ। একই সঙ্গে একাত্তর সাল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মানুষের জন্য অত্যন্ত সম্মানের। মুক্তিযুদ্ধের সকল কর্মকা- যদিও পরিচালিত হয়েছে পূর্ববঙ্গ, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মাটিতে, তথাপি যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে সীমান্তবর্তী ভারতের ভূখণ্ডে, সেখানকার সরকার ও সকল স্তরের মানুষের সার্বিক সহযোগিতায়। পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ও বর্বর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের মাটিতে, যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সর্বাধিক শরণার্থী বিপর্যয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনাবর্তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার এবং সেই সঙ্গে দেশটির সকল স্তরের মানুষ ও সশস্ত্র বাহিনীর অবদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্কর ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসে ছিলেন। তিনি ও জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশ কনসার্টের আয়োজন করে দশ লাখ ডলার তুলে শরণার্থী শিবিরের শিশুদের জন্য ইউনিসেফকে দিয়েছিলেন। মকবুল ফিদা হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি এঁকে বোম্বের (বর্তমানে মুম্বাই) রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, শ্যামল দত্ত রায়, গণেশ পাইনের মতো খ্যাতিমান শিল্পীরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাসের পর মাস বাংলাদেশের ওপর ছবি এঁকে বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পী বাঁধন দাস ছবি আঁকা ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে তার এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন।

অন্নদাশঙ্কর রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, প্রণব রঞ্জন রায়, তরুণ সান্যাল, অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, নির্মল চক্রবর্তী, ড. ফুলরেনু গুহ, দিলীপ বসু, ইলা মিত্র, রমেন মিত্র, আবদুর রহমান, ডা. গণি, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। নীরেন সেনগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, জগদীশ দে, বিমল দাশগুপ্তের মতো শিল্পীরা দিল্লী, বোম্বে আর কলকাতায় প্রদর্শনী করে ছবি বিক্রির টাকা বাংলাদেশ তহবিলে দিয়েছিলেন।

একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর দমননীতির বিরুদ্ধে মুক্তিপাগল জনতার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিত্যই মিছিল, মিটিংয়ে মুখর ছিল পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য। শুধু তাই নয়; বরং বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতেও ভারতের মানুষজন সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছিল। প্রতিদিন দলে দলে নারী-পুরুষ কেউ বা মাথায় একটি পুঁটলি নিয়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে পারি দিয়েছিলেন। এসব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও অন্নের সংস্থান করার বিষয়টি ছিল রীতিমতো একটি চ্যালেঞ্জ। গড়ে প্রতিদিন চল্লিশ হাজার শরণার্থী প্রবেশ করেছে ভারতে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৬ মে, ১৯৭১ সালে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নেমে সেখান থেকে হলদিবাড়ি ও দেওয়ানগঞ্জ শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। তিনি শরণার্থীদের বলেনে যে, ভারত গরিব দেশ এবং ভারতের লোকেরাও গরিব; তবুও ভারত সাধ্যমতো এই শরণার্থীদের সেবা করবে। তৎকালে হলদিবাড়ি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী ওই কথাগুলো উচ্চারণ করেন। শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রধানমন্ত্রী খুব সংক্ষিপ্ত আকারে বক্তৃতা করেন। কিন্তু তাঁর বক্তৃতায় কোন বাহুল্যতা ছিল না। তিনি শরণার্থীদের একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেন না যে, তারা ভারতের বহু সমস্যার মধ্যে আর একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন; তবুও ভারত এটাকে আপনজনের ব্যাপার বলে মনে করছে।

মার্কিন সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর ওয়াশিংটনে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন যে, ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ৩০০ শিশু মারা যাচ্ছে। তিনি ছিলেন সিনেটের শরণার্থী সংক্রান্ত জুডিশিয়ারি সাব-কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, নতুন বৈদেশিক সাহায্য বিলে কংগ্রেস যদি কোন অর্থ মঞ্জুর না করে, তবে তিনি শরণার্থীদের জন্য ২৫ কোটি ডলার মঞ্জুরির জন্য একটি বিল পেশ করবেন। শরণার্থী শিবিরে বিবর্ণমুখ দেখে ভারতের সাধারণ মানুষেরা চুপ করে বসে থাকেনি; বরং যে যার অবস্থান থেকে সর্বত্রভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। কর্মীরা প্রায় প্রতিটি প্রশিক্ষণ শিবির ও শরণার্থী শিবিরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট একাকার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষগুলো ত্রাণসামগ্রী, কাপড় ও চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করেন। সুনামির ঢেউয়ের মতোই সাধারণ মানুষের স্রোত পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়লেও সেখানকার অধিবাসীরা হাল ছেড়ে দেয়নি। সার্বিক অবস্থা দেখে শরণার্থী সাহায্যে রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য উদাত্ত আহ্বান করেন।

একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী ঘাতক সামরিক সরকার, অন্যদিকে মুক্তিকামী জনতা। যাই হোক, ভারতের সাধারণ মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র। কেউ কেউ ডাক্তারের পাশে থেকে শরণার্থীদের সেবা-শুশ্রƒষায় নিয়োজিত হয়ে যায়। এভাবেই কেউ ধাত্রী প্রশিক্ষণ, নার্স প্রশিক্ষণ নিয়ে শরণার্থী শিবিরে কাজ করেছেন অবিরত। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। মাস কয়েকের মধ্যে এ সকল অঞ্চলে হাজার হাজার শরণার্থী এসে অবস্থান করলে এক অমানবিক অবস্থার জন্ম নেয়। উল্লিখিত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বসবাসের স্থান দেয়ার পাশাপাশি খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। একাত্তরে ভারতে যারা শরণার্থী শিবিরে দিনভর কাজ করতেন। সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাত্তর সালে ভারত পরিণত হয়েছিল হাজার হাজার শরণার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রশাসনের পাশাপাশি ধনী, গরিব ও জাতি-ধর্মনির্বিশেষে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। এ অবদান নগণ্য নয়; বরং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সত্য।

ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি

১৯৭১ সালের অগাস্ট মাসে রাশিয়ার সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি করে ভারত। এই বিষয়টি ভীষণ চিন্তায় ফেলে আমেরিকাকে। তখন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এই মৈত্রী চুক্তিকে ‘বোম্বশেল’ হিসেবে বর্ণনা করেন। পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন চুক্তিকে দায়ী করেন কিসিঞ্জার। ‘হোয়াইট হাউজ ইয়ারস’ বইতে মি. কিসিঞ্জার লিখছেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে থামাতে পারতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি। প্রকৃতপক্ষে মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধকে উসকে দিয়েছে।”

মি. কিসিঞ্জার লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৪শে নভেম্বর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকেছিল বলে ইন্দিরা গান্ধী স্বীকার করেন। একাজ তারা একবারই করেছিল বলে মিসেস গান্ধী বলেন।

মিত্রবাহিনী গঠন

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর এদিন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এদিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নয় মাসের যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে আনাচে কানাচে। সর্বত্রই পাকিস্তানি বাহিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী আক্রমণের শিকার হয়ে পিছু হটছিল। ক্রমেই বেশি সংখ্যক এলাকায় উড়ছিল বাংলাদেশের পতাকা। এদিকে মুক্তিযুদ্ধকে একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা চলমান ছিল। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। অর্থাৎ ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী। ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক জনসভায় ভাষণদানকালে কোনো রকম উস্কানি ছাড়াই পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানগুলো ভারতের পশ্চিম সীমান্তে অমৃতসর, আম্বালা ও উধমপুরসহ কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে। এতে করে ভারতজুড়ে জারি হয় জরুরি আইন। সে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তপর্ব। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।’

৩ ডিসেম্বর গভীর রাতেই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধরত বাংলাদেশের সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী যোগ দেয়।

ভারতীয় সেনাদের আত্মদান

১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর গভীর রাত থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারত- বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর লড়াইয়ে বাংলাদেশের যোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় বহু সৈন্য শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনার নাম, ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত সরকার ও তাঁদের সেনাবাহিনীর অনেক অবদান রয়েছে যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসেরই অংশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যেখানে অন্যদেশের স্বাধীনতার জন্য এত সংখ্যক সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।

একাত্তরে ভারত আভাস দিয়েছিল যে, সীমান্তের ওপারের মানুষ এপাড়ের মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম। এ আভাস মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। ভারতের মানুষ বিভিন্ন রসদ জোগান দিয়েছিল সেটি শুধু মুক্তিসেনাদের উৎসাহিত করেনি বরং তাদের বাহুতে নতুন করে বল সংযোজিত হয়েছিল। ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত রসদ পাঠানো হয়েছিল। ভারতের শরণার্থী শিবিরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, আহতদের রক্তদানের ব্যবস্থা করতে কোনো প্রকার কাল বিলম্ব করা হয়নি। শুরুর দিকে একটু কষ্ট হলেও ধীরে ধীরে শরণার্থীদের জন্য সুসময় আসতে থাকে। প্রতিটি শরণার্থীকে কলেরা ভ্যাকসিন, মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট, দুধ এবং সবচেয়ে বড়ো যেটা দু’বেলা পেটপুরে ভাতের জোগান দেওয়া হয়েছিল।

ভারতের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ

নানামুখি সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে ভারত সরকার, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের সেনাবাহিনী ও ভারতের জনগণ যে বিশেষ অবদান রেখেছে তা বাঙালি জাতি চিরদিন গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে।

লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

ডিজাইন ও কারিগরি: চট্টগ্রাম লাইভ
উপরে