গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত চীন
উইঘুর এবং অন্যান্য প্রধান জাতিগত গোষ্ঠীর উপর কঠোর ব্যবস্থার দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘ বিলম্বিত প্রতিবেদনে, জাতিসংঘ চীনকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছে, যা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ গঠন করতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার, বেইজিং এ মূল্যায়নের সমালোচনা জানিয়ে এটিকে পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বারা কেবলমাত্র একটি প্রহসন বলে দাবি করেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি জানায়, চীন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর এক মিলিয়ন বা তার বেশিসংখ্যক লোকেদের আটকে রেখেছে যেখানে তারা যৌন নিপীড়ন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং তাদেরকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ভাষা ত্যাগ করতেও বাধ্য করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সূদুর পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের শিবিরগুলোকে চরমপন্থার বিরুদ্ধে একটি নৃশংস অভিযান হিসেবে বর্ণনা করেছে, যেখানে কঠোর জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন এবং মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতার উপরেও ব্যাপক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাবিদ, প্রচার সংগঠনসমূহ এবং মিডিয়া দ্বারা গঠিত রিপোর্টকে সমর্থন জানায়। যদিও এর প্রভাব কি হবে তা এখনো অনিশ্চিত।
উইঘুরদের মধ্যে যারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, তাদের মধ্যে একটি সন্তুষ্টির অনুভূতি দেখা যায় যে শেষ পর্যন্ত রিপোর্ট টি প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলো এই ভেবে যে এটি কখনোই প্রকাশিত হবে না। অনেকেই এটিকে তাদের বছরের পর বছরের প্রচেষ্টার বিজয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
রায়হানআসাত, একজন উইঘুর আইনজীবী যার ভাই জিনজিয়াং-এ আটক রয়েছে, তিনি প্রতিবেদনটি সম্পর্কে বলেছেন, “এটি মোটামুটি ধ্বংসাত্মক এবং মানবতার বিরুদ্ধে চীনের অপরাধের একটি শক্তিশালী অভিযোগ পত্র।”
চীনা সরকার দাবি করেছে যে উইঘুররা বহু বছর ধরেই সন্ত্রাসী। আমরা এখন নিশ্চিতভাবেই ঘোষণা করতে পারি যে তারা সন্ত্রাসী। গবেষণাটি চীন এবং বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ এবং সেইসাথে মানবাধিকার সংস্থাগুলির মধ্যে বিতর্কের বিষয় ছিল, যারা এর প্রকাশ হওয়ার ক্ষেত্রে বারবার বিলম্বের নিন্দা করে।
এই গবেষণা এখন মানবাধিকার সংস্থা, জাপান এবং জার্মানি দ্বারা স্বীকৃত।
বুধবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চীন তার সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা বিরোধী কার্যকলাপ দ্বারা সর্বোচ্চ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এই সীমালঙ্ঘনগুলি সংশোধন করার জন্য জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং খোদ চীনের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য দাবি জানানো হয়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলি আবারও অনুরোধ করছে যে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল আগামী মাসে তার বৈঠকের আগে দাবিগুলি দেখার জন্য একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করবে। যাইহোক চীন তার কার্যকলাপের জন্য হওয়া সমালোচনাগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিনের মতে, ” এই রিপোর্ট টি একটি জোড়াতালি ছাড়া কিছুই নয়। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলিকে সুযোগ করে দিচ্ছে চীনের কৌশলগত উপায়ে জিনজিয়াংকে ব্যবহার করার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করার।
এটি আরও একবার প্রমাণ করে যে কীভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির একটি হাতিয়ার এবং সাহায্যকারীতে পরিণত হয়েছে৷
জাতিসংঘ তার ক্ষোভের বিবৃতিস্বরূপ “জিনজিয়াংয়ে সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই: সত্য ও তথ্য” শিরোনামে ১২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে, যেখানে চীনের করা প্রশ্নের সমস্ত উত্তর রয়েছে।
জাতিসংঘের রিপোর্টটি মূলত বিশ জনেরও বেশি প্রাক্তন বন্দী এবং আটজন অন্যান্য বন্দীদের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ছিল। তারা তাদেরকে লাঠি দিয়ে মারধরের কথা স্বীকার করেছে, তাদের মুখে পানি ঢেলে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বলেছে এবং ছোট একটি স্টুলের উপর তাদের দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে বলে জানিয়েছে।
কিছু বন্দী বলেছেন যে তাদের প্রার্থনা করতে নিষেধ করা হয়েছিল এবং তাদের সহবন্দীদের মধ্যে যারা আইন লঙ্ঘন করতে পারে বা প্রার্থনা করতে পারে তাদের প্রতি নজর রাখতে সারা রাত শিফটে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। মহিলারা নিরাপত্তা অফিসারদের সাথে ওরাল সেক্স করতে বা বিশাল ভিড়ের সামনে গাইনোকোলজিকাল পরীক্ষা করাতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন নির্যাতনের দাবিগুলি বিশ্বাসযোগ্য এবং বন্দীদের নির্যাতনের বিবরণগুলো, অন্যান্য নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ তাদের শারীরিক ক্ষতচিহ্ন দ্বারা সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “উইঘুর এবং অন্যান্য গোষ্ঠী প্রধানত মুসলিম গোষ্ঠীর সদস্যদের স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক বন্দীদের পরিমাণ সাধারণভাবে বিধিনিষেধ এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ, বিশেষ করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ গঠন করতে পারে।”
এটি জিনজিয়াংয়ে কথিত গণহত্যার কোন উল্লেখ করেনি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ কয়েকটি দেশ যার জন্য চীনকে অভিযুক্ত করেছিল। যাই হোক এটা ধারণা করা যায় যে ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বৃহৎ পরিমাণের লোকেদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল। মানবাধিকার অফিস অবশ্য বলেছে যে, জিনজিয়াং বন্দীশিবিরে এক মিলিয়ন বা তার বেশি বন্দী ছিল এই অনুমান প্রমাণ করতে তারা সক্ষম হয় নি।
বেইজিং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার সুবিধা হিসাবে উল্লেখ করা অনেকগুলো শিবির বন্ধ করে দিয়েছে। তবে কয়েক হাজার ব্যক্তি এখনও কারাগারে বন্দী রয়েছে, এবং তাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি।
সমীক্ষাটি চীনকে নির্বিচারে গ্রেফতারকৃত সকল ব্যক্তিকে মুক্ত করতে এবং যারা তাদের পরিবার হারিয়ে ফেলেছে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।