সাংসদ নিজাম হাজারীর হাত ধরেই উত্থান ঘটে দুধর্ষ সন্ত্রাসী কাউন্সিলর কালামের!

প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২১; সময়: ২:০৮ অপরাহ্ণ |

ফেনীতে গরু বহন করা গাড়ি লুট করতে বাধা দেওয়ায় ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মূল হোতা ফেনী পৌরসভার কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম বিগত সাড়ে তিন বছরে আগেও এলাকায় যুবদল নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ফেনীর বহুল আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা রতন হত্যা মামলার অন্যতম আসামিও ছিলেন তিনি। সাবেক সাংসদ বিএনপি নেতা ভিপি জয়নালের খুবই ঘনিষ্ঠজন ছিলেন কালাম। ক্ষমতার মোহে যুবলীগের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মাত্র এক বছরের মধ্যেই আওয়ামী লীগের নেতা বনে যান তিনি৷

তবে যুবদল নেতা আবুল কালামের যুবলীগের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের ব্যাপারে স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আবুল কালামের রাতারাতি এই বেপরোয়া উত্থানের পেছনে রয়েছেন ফেনী-২ আসনের সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী। তাঁর হাত ধরেই কালাম আওয়ামীলীগে যোগ দেন। এমনকি ৬ নং সুলতানপুর ওয়ার্ডের বাসিন্দা না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলরও বানানো হয়েছে। সেই ওয়ার্ডে তাঁকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও করা হয়েছে।

হেলিকপ্টারে ফেনী-২ আসনের সাংসত নিজাম হাজারীর সাথে কাউন্সিলর কালাম।

ফেনী সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, পৌরসভা কাউন্সিলর কালামকে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে। ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

গত বৃহস্পতিবার ফেনীর কলেজ রোডের সাহেব বাড়ি এলাকায় গভীর রাতে গরু বহনকারী ট্রাকটি লুট করতে বাধা দেওয়ায় মো. শাহজালাল (৩৫) নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কালাম ও তাঁর তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। হত্যাকান্ডের পর কাউন্সিলর কালাম পালিয়ে গেলেও তাঁর দুই সহযোগী নাইম হাসান ও মো. সাগরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে কালামের সহযোগী নাইম গতকাল শনিবার আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, কাউন্সিলর কালাম নিজেই গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করেন। তারপর তারা তিনজনে (গ্রেপ্তার দুজনসহ) মিলে লাশটি পুকুরে ফেলে দেন।

“কালাম- নামা”-

কখনো স্কুলে যাননি। ছোটবেলায় ছিলেন লেদ মেশিনের শ্রমিক। তরুণ বয়সে জড়িয়ে পড়েন ছিনতাইসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। ১৯৯৬ সালে ভিপি জয়নালের হাত ধরে বিএনপির ক্যাডার হিসেবে রাজনীতির মাঠে আসেন। আর ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এখন পৌর কাউন্সিলর। ফেনী শহরের উত্তরাংশের আতঙ্কের নাম আবুল কালাম। গত বৃহস্পতিবার রাতে এক গরু ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার পর নতুন করে আলোচনায় আসেন।

এলাকাবাসী জানায়, ফেনী পৌর এলাকার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত মফিজুর রহমানের ছেলে আবুল কালাম। বাবা ছিলেন বাবুর্চি। ছোটবেলায় কালাম একাডেমি এলাকায় লেদ মেশিন কারখানায় কাজ করতেন। তরুণ বয়সে রেলগেট থেকে সদর হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত এলাকায় সড়কে চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে ভিপি জয়নাল তাঁর দলবলসহ বিএনপিতে যোগ দেন। ওই সময় কিছুদিন ভিপি জয়নালের ফলেশ্বর এলাকার বাড়ি দেখভাল করতেন। সেখান থেকে যুবদলের সক্রিয় ক্যাডার। ২০১৮ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। প্রথমে ফেনী পৌর এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। চলতি বছর জানুয়ারিতে ফেনী পৌরসভা নির্বাচনে ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

তার নামে যত মামলা :

জানা গেছে, হত্যা, অস্ত্রসহ প্রায় দেড় ডজন মামলার আসামি আবুল কালাম। ১৯৯৬ সালে ফেনী সদর উপজেলার কাজীরবাগ ইউনিয়নের মো. সামছু ওরফে স্বর্ণ সামছুর বাড়ি থেকে ভিপি জয়নালের সঙ্গে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে বহুদিন জেল খাটেন। ’৯৮ সালে ফেনী পৌরসভার তৎকালীন কমিশনার ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন রতন হত্যা মামলায়ও আসামি কালাম। এর বাইরে বেশ কয়েকটি চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি মামলার আসামি তিনি। ২০০৪ সালে ফেনী কলেজ রোডের শহীদ হোসেন উদ্দিন বিপণিবিতানের ব্যবসায়ী মো. কাদের ওরফে হুন্ডি কাদেরের মোটা অঙ্কের টাকা ছিনতাই ঘটনায়ও কালাম জড়িত বলে জানান দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

তাঁর হামলার শিকার যাঁরা :

বিভিন্ন স্থানে কালামের হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে। ২০১৮ সালের শেষভাগে ও ২০১৯ সালের শুরুতে ফেনী মিশন হাসপাতালের কর্মকর্তা তারেক ইকবাল মনিকে ফেনী সদরের সুলতানপুরে উপজেলা পরিষদের সামনে মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেন। কাজীরবাগ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সামছুল হককে ফেনী পলিটেকনিক এলাকায় পিটিয়ে আহত করেন। ফেনী সদর হাসপাতালের সামনে হামলা চালান ফরহাদনগর ইউপি চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বাচ্চুর ওপর।

একাধিক স্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রক :

ফেনী শহরের উত্তর-পূর্বাংশের এক আতঙ্কের নাম কাউন্সিলর কালাম। সদর হাসপাতাল মোড়ের দুটি বাসস্ট্যান্ড, চারটি সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড ও পাঁচটি টমটম স্ট্যান্ড কালামের নিয়ন্ত্রণে। ফেনী সদর হাসপাতালের বিশাল এলাকা, শিক্ষা প্রকৌশল অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস, ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, পশ্চিমে সুলতানপুর, বারাহিপুর, আমিনবাজার, আমতলীসহ বিরাট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন কালাম।

দলের বক্তব্য :

কাউন্সিলর কালামের অপকর্মের দায় নিতে রাজি নন দলের নেতারা। ফেনী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি অমর কৃষ্ণ মজুমদার বলেন, গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আমরা সবাই বিব্রত। যিনি বা যাঁরাই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকুন, আমরা তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আইনুল কবির শামীম বলেন, দলের কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়লে দায়ভার ওই ব্যক্তির। তাঁকে এরই মধ্যে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

ডিজাইন ও কারিগরি: চট্টগ্রাম লাইভ
উপরে