আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
বৈষ্ণব কবির ভাষায়- আজ ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’। ১৪২৯ বঙ্গাব্দের বর্ষার প্রথম দিনপঞ্জিকার অনুশাসনে আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন।
প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের রুদ্র দহন ছিন্ন করে আজ বর্ষার দিন এলো। তৃষিত হৃদয়ে, পুষ্পে-বৃক্ষে, পত্র-পল্লবে নতুন প্রাণের নতুন গানের সুর নিয়ে আজ এই বর্ষা সমাগত।
মহাকবি কালিদাস তার ‘মেঘদূত’ কাব্যে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহ কাতর যক্ষ মেঘকে দূত করে কৈলাশে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে।
বৃষ্টির শব্দে যক্ষের মতোই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হৃদয় যেন এক অজানা বিরহে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তাই রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের উদ্দেশে লিখেছিলেন-‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে/ কোন পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ লিখেছিলে মেঘদূত। মেঘমন্দ্র শ্লোক বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক/রাখিয়াছ আপন আঁধার স্তরে স্তরে/ সঘন সংগীত মাঝে পূঞ্জীভূত ক’রে।’
আষাঢ় মানেই সময়-অসময়ে ঝমাঝম বৃষ্টি, কর্দমাক্ত পথঘাট, খাল-বিলে থৈ থৈ পানি, নদীতে বয়ে চলা ছবির মতো পাল তোলা নৌকার সারি। বর্ষার নতুন জলে স্নান সেরে প্রকৃতির মনও যেন নেচে ওঠে। ফুলে ফুলে শোভিত হয় প্রকৃতি। তাল তমাল শাল পিয়াল আর মরাল কপোতের বন বীথিকায় চোখে পড়ে বকুল, কদম, জারুল, পারুল, কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়াসহ অসংখ্য ফুল।
আষাঢ়ে প্রকৃতি রূপ-রঙে হয়ে ওঠে ঢল ঢল। তাপদাহে চৌচির মাঠ-ঘাট খাল-বিল বনবিথিকায় জেগে ওঠে নবীন প্রাণের ছন্দ। চারিধারে অথৈ থৈ থৈ পানিতে আবহমান বাংলার রূপ হয় অপরূপ রূপবতী সলিল দুহিতা। বর্ষার সৌন্দর্যে বিমোহিত মধ্যযুগের কবি জয়দেবের কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়েছে- ‘মেঘৈর্মে দুরম্বরং, বণভুব শ্যামাস্ত মালদ্রুমৈ।’
বর্ষা কবিদের ঋতু। বর্ষা নিয়ে কবিরা লিখেছেন অসংখ্য কবিতা-গল্প-গান। ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান” বর্ষা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই আবেগময়, প্রেমসিক্ত গান যেন সে কথাই বলে।
শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, বাংলা সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত বহু কবিই বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যে মোহিত ও মুগ্ধ, বর্ষার আবাহনে উচ্ছ্বসিত ও মুখর। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি’।
কবি সুফিয়া কামাল তার বহু কবিতায় প্রকৃতির বিদগ্ধ রূপ প্রকাশ করেছেন সযত্নে। প্রায় সব ক’টি ঋতু নিয়েই কবি কবিতা লিখেছেন। বর্ষার অনবদ্যতা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
‘আমি বর্ষা, আসিলাম
গ্রীষ্মের প্রদাহ শেষ করি
মায়ার কাজল চোখে
মমতায় বর্মপুট ভরি।’
কবি বুদ্ধদেব বসু বর্ষায় মেঘের কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছেন। কবির হৃদয়ে বর্ষার আবেদন গভীর। কবির আবেগঘন আকুতি যেন ঝড়ে পড়েছে এভাবে
‘নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে
জোয়ার এলো জলে;
আকাশ ভরা মেঘের ভারে
বিদ্যুতের ব্যথা
গুমরে উঠে জানায় শুধু
অবোধ আকুলতা।’
তাই বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ ভাবাই যায় না। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে নকশীকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে বর্ষার অপরূপ রূপ বর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত ও চিরকালীন হয়ে আছে।